সৌদিতে শৌচাগারের পানি খেয়ে কাটিয়েছেন সাত দিন

সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় নারীদের। সেখান থেকে পছন্দের গৃহকর্মী বেছে নেন সৌদি আরবের নাগরিকরা। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চেহারা ও শারীরিক গঠন প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু কাজে গেলেই কপালে জোটে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। না খাইয়ে রেখে কাজ করতে বাধ্য করা হয় দিনের পর দিন।

এমন দুর্বিসহ যন্ত্রণার বর্ণনা দিলেন সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরা তিন নারী। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে সৌদি আরব থেকে দেশের মাটিতে ফিরে আসেন তাঁরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই ছুটে আসেন সংবাদকর্মীদের কাছে।

ইফতারের পর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এসে সাংবাদিকদের জানান, তাদের ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা।

এক নারী জানান, তাঁর বাড়ি নওগাঁ জেলায়। এ বছরের ২৩ এপ্রিল তিনিসহ ১০ জন নারী সৌদি আরবে পাড়ি জমান আল মনসুর ওভারসিজ অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে। রূপালী ও রেজা নামের দুই দালাল তাঁকে এই এজেন্সির কাছে হস্তান্তর করেন।

সৌদি আরব যাওয়ার আগে এজেন্সি থেকে ‘জনসন’ নামের একজনের ফোন নম্বর দেওয়া হয়। ভারতীয় নাগরিক এই জনসনই তাদেরকে জেদ্দা বিমানবন্দরে গ্রহণ করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আরেক ভারতীয় নাগরিক সাজিদ তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব নেন।

জীবন ও জীবিকার তাগিদে সুদূর প্রবাসে গিয়ে ১০ নারী নানা সন্দেহ সংশয়ের মধ্যেও যখন একটু একটু করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই শুরু হয় ছন্দপতন।

ওই নারী জানান, তাদেরকে সৌদি আরবের দাম্মামের একটি জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। মনে হয় এ যেন নারীর হাট! সৌদি আরবের লোকজন এসে নানাভাবে তাদের পছন্দ করেন। পছন্দ হলে চুমু খান।

এরপর সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি যে বাড়িতে কাজ পান সেখানে গিয়েই নানামুখি জটিলতায় পড়েন। ভাষা না জানাটা এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা।

নারী জানান, ওই বাড়িতে তাঁকে ঠিক মতো খেতে দিতো না। প্রতিদিন মারধর করত। বাড়ি থেকে বের হয়ে ক্যাম্প অফিসে যেতে চাইলে শুরু হতো অমানুষিক নির্যাতন। একদিন বাড়ির লোকজন তিন তলার সিঁড়ির ওপর থেকে তাঁকে লাথি মারেন।

লাথি খেয়ে তিনি গড়াতে গড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে পড়ে যান। একপর্যায়ে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান ক্যাম্প অফিসে। কিন্তু সেখানে জনসন ও সাজিদ তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন ওই বাড়িতে কাজে ফেরত যেতে।

এরই মধ্যে কাজ থেকে পালিয়ে আসেন সাতক্ষীরা ও গাইবান্ধা জেলার দুই নারী। তাঁরা যেতে রাজি না হওয়ায় ক্যাম্প অফিসেই তাঁদের মারধর করা হয়। এদের মধ্যে একজন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দালাল মনিরের মাধ্যমে ও আরেকজন গাইবান্ধার দালাল তারেকের মাধ্যমে আল মনসুর ট্রাভেলস এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।

নওগাঁর বাসিন্দা ওই নারী জানান, একপর্যায়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন আর কাজে যাবেন না, দেশে ফিরবেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সেখানকার ক্যাম্প অফিসের লোকজন তাদেরকে দেশে ফিরে আসতে দেবে না।

একপর্যায়ে তাদেরকে ভবনের ছাদে আটকে রাখে। সেখানে তারা সাত দিন অবস্থান করে। এ সময় তাদেরকে পানিও খেতে দেওয়া হয়নি। নোংরা শৌচাগারের পানি খেয়ে তারা ওই সাতদিন জীবনধারণ করেছেন।

শৌচাগারটিও ব্যবহারের অনুপযোগী থাকায় পলিথিনের ব্যাগে কিংবা একটি তোয়ালের ভেতরে পায়খানা প্রস্রাব করে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে অনেক কাকুতি-মিনতির পর ক্যাম্প অফিস থেকে তাদের ভিসা, টিকিট ও পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়। তারপর তাঁরা তিনজন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন এবং সম্পূর্ণ খালি হাতে দেশে ফিরে আসেন।

নওগাঁর বাড়িতে ওই নারীর দেড় বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।

সাতক্ষীরার আরেক নারীর বাড়িতে সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে ও ১১ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। তাঁরও স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আর গাইবান্ধার ওই নারী তাঁর পরিবার সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি হননি।

ফিরে আসা তিন নারীর দাবি, যেসব দালালের খপ্পড়ে পড়ে আজ তাঁরা সর্বস্ব হারিয়েছেন তাঁদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হোক। একই সঙ্গে ট্রাভেলস এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে সরকার যেন তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে।

শেয়ার করুন: