জামালপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালালদের যৌথ ‘বকশিশ’ কারবারের শিকার গ্রাহকরা।
অতিরিক্ত টাকা খরচ ছাড়া এখানে পাসপোর্ট মেলে না। দালালদের মধ্যে মতিউর রহমান মতি ওরফে ‘মতি মামা’ নামের একজন আনসার সদস্য এই দালালি করেই কোটিপতি হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনিই এখানে পাসপোর্টের দালালি নিয়ন্ত্রণ করেন।
জামালপুর শহরের কাছারিপাড়ায় ভাড়া বাসায় ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে জামালপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরু থেকেই সেখানে দালালদের দৌরাত্ম্য চলছে। সরাসরি পাসপোর্টের আবেদনপত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ পাসপোর্ট অফিসের কাউন্টারে জমা দিলে অযথা বিভিন্ন ত্রুটি ধরে হয়রানি করা হয়।
ফলে বাধ্য হয়েই ঝামেলা এড়াতে দালালদের শরণাপন্ন হয় পাসপোর্ট আবেদনকারীরা। পরে একই আবেদন ফরম দালালদের মাধ্যমে এক হাজার টাকা ‘বকশিশ’ নিয়ে জমা নেওয়া হয়।
‘বকশিশ’ ও পুলিশ ভেরিফিকেশন ‘খরচ’সহ অন্যান্য খরচের কথা বলে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে নিচ্ছে দালালরা। তবে এই অফিসে দালালদের অস্তিত্বই স্বীকার করে না কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামালপুর পাসপোর্ট অফিসের চিহ্নিত প্রভাবশালী দালাল মতিউর রহমান মতি ওরফে ‘মতি মামা’র বাড়ি জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নে। তিনি বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর একজন নিয়মিত সদস্য। সর্বশেষ ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসে চুক্তিভিত্তিক আনসার সদস্য হিসেবে চাকরি করেছেন বছরদশেক।
সেখান থেকেই তাঁর দালালি ব্যবসা শুরু। চাকরির চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে এবং জামালপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস চালু হলে মতি আস্তানা গাড়েন জামালপুরে। পাসপোর্ট অফিসের সামনেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। পরে এখানে বেশ কিছু ঝামেলা হওয়ায় বাসা বদল করেন।
বর্তমানে তিনি শহরের শেখেরভিটা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। পাসপোর্ট অফিসের কাছেই তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকায় ৪ শতাংশ জমি কিনেছেন। সম্প্রতি একটি ইজি বাইক কিনে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন।
এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়া সিলে কাগজপত্র সত্যায়িত করা এবং ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে; প্রতারণার অভিযোগে তিনটি মামলা রয়েছে।
আনসার বাহিনীতে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে মতিউর রহমানের খুব কষ্টে দিন কাটত। তখন তিনি বেশ কিছুদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে দুধ কিনে শহরে বেচতেন। গ্রামে হাটে-বাজারে কিছুদিন মুরগি, ডিম বিক্রি করেও সংসার চালান।
ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসে চাকরির সুবাধে দ্রুত পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার দালালিতে জড়িয়ে তাঁর জীবনের চাকা ঘুরে যায়। জামালপুর পাসপোর্ট অফিস থেকে ঢাকা পাসপোর্ট অফিস এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ বিভাগে তাঁর হাত খুব লম্বা।
তাঁর হাত ধরে স্থানীয় কিছু যুবকের প্রতিদিনের নগদ কাঁচা টাকা উপার্জনের উপায় হয়েছে। তাঁদের কাছে ও পাসপোর্ট অফিসের আশপাশের এলাকায় তিনি ‘মতি মামা’ নামে পরিচিত।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একটি সাধারণ পাসপোর্ট করতে তিন হাজার ৪৫০ টাকা ও জরুরি পাসপোর্ট করতে ছয় হাজার ৯০০ টাকা লাগে। কিন্তু দালাল মতিউর রহমান যেকোনো ধরনের পাসপোর্ট দ্রুত সময়ের মধ্যে বের করে দেওয়ার কথা বলে একজন আবেদনকারীর কাছ থেকে সর্বনিম্ন ছয় হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন।
জামালপুর পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেনের দেওয়া তথ্য মতে, এই অফিসে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি পাসপোর্ট আবেদন জমা পড়ে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন ৮০ থেকে শতাধিক আবেদন জমা পড়ে এখানে। বেশির ভাগ আবেদনকারীই অফিসে আসার আগেই দালালদের খপ্পরে পড়ে যায়।
অন্তত ২০ জন সহযোগীর হাত হয়ে দালাল মতিউরের হাতেই কাজগুলো যায়। তারা চার পাতার আবেদন ফরম পূরণ করা থেকে পাসপোর্ট হাতে আসা পর্যন্ত যেখানে যা টাকা খরচ করতে হয়, তা দিয়ে দ্রুত পাসপোর্ট করিয়ে দেয়।
এই অফিস ঘিরে আব্দুল্লাহ ও শাহাবুদ্দিন নামের আরো দুই দালাল অন্তত ১৫ জন সহযোগীর মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে আসা লোকদের অফিসে যাওয়ার সময় রাস্তা থেকেই কবজা করে নেন। তবে একচেটিয়াভাবে পাসপোর্ট করানোর কাজগুলো চলে যায় মতিউরের হাতেই। এ নিয়ে অন্য দালালদের সঙ্গে দা-কুমড়ার সম্পর্ক চলছে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, মতিউর রহমান প্রতিদিন ১০-১৫টা পাসপোর্ট আবেদন জমা করিয়ে সব খরচ বাদে পকেটে অন্তত ২০ হাজার টাকা তোলেন। প্রতি মাসে তাঁর আয় হচ্ছে সর্বনিম্ন চার লাখ টাকা। কোনো কোনো মাসে এরও বেশি। তিন বছরে এভাবে তিনি কোটি টাকার ওপর হাতিয়ে নিয়েছেন। অন্য দালালদের পকেটে প্রতিদিন পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠে।
মতিউর বলেন, ‘একটি পাসপোর্ট করতে অফিসে এক হাজার টাকা বকশিশ আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ৬০০ টাকা বকশিশ দিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিস ম্যানেজ করতে না পারলে পাসপোর্ট বের হতে অনেক সময় লাগে। সবাই জানে ,কাজটা আমি খুব ভালো বুঝি; তাই লোকজন আমার কাছেই আসে।’
জামালপুর পৌরসভার কাউন্সিলর নাসরিন আক্তার বলেন, ‘এখানে দালাল নির্মূলে প্রশাসনের নজরদারি করা দরকার।’
অফিসের সহকারী পরিচালক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘অফিসে পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতারা যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে জন্য আমি সার্বক্ষণিক নজরদারি করি। এখানে দালালদের কোনো স্থান নেই।
সেবাগ্রহীতাদেরও সব সময় সাবধান করে থাকি।’ অফিসে এক হাজার টাকা না দিলে পাসপোর্ট পাস হয় না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ।