সুড়ঙ্গ

লালবাগ সুড়ঙ্গের যত কল্পকাহিনী

মুঘল ঐতিহ্য নিয়ে এখনো টিকে আছে লালবাগ কেল্লা। তবে নেই আদি কারুকাজ ও সৌন্দর্য। আজও আছে এর ভিতরে থাকা সুড়ঙ্গ নিয়ে নানা রহস্য। কল্পকাহিনী। লালবাগ কেল্লার দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালের সঙ্গে যুক্ত এ সুড়ঙ্গপথটি। সুড়ঙ্গের পুরনো লোহার গেটে ঝুলছে তালা। সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পাশেই আনসার ক্যাম্প। শুধু সুড়ঙ্গ নয়, এই বিশাল আকারের প্রাচীন নিদর্শনটি ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত রহস্যগুলোর আজও কোনো স্পষ্ট উত্তর মেলেনি।

দুর্গটির নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লালবাগ কেল্লার নিচে রয়েছে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ। এগুলো সুবেদারদের আমলে তৈরি। বিপদের সময় পালানোর জন্য এসব সুড়ঙ্গপথ। তবে একটি সুড়ঙ্গ এখনো বিদ্যমান, যার ভিতরে কেউ ঢুকলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কেউ এই সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করলে সে আর ফিরে আসে না।

পরীক্ষা করার জন্য একবার দুটি কুকুরকে শেকলে বেঁধে সেই সুড়ঙ্গে নামানো হয়েছিল। শেকল ফেরত এলেও কুকুর দুটো কিন্তু ফিরে আসেনি। আবার লোকমুখে শোনা যায়, এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পাশেই বুড়িগঙ্গা নদীতে যাওয়া যেত। সুড়ঙ্গমুখ থেকে বেরিয়েই নৌকায় উঠে যাওয়া যেত জিঞ্জিরা প্রাসাদে। আবার নদীর বাতাস অনুভবের জন্য ওই সময়ের সেনাপতিরা এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতেন। তবে এসব কথাকে কল্পকাহিনী বলে দাবি করেছে লালবাগ কেল্লার কাস্টোডিয়ান কার্যালয়।

এখানকার লিটন নামে এক কর্মচারী জানান, এসব কথার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যুদ্ধের সময় মুঘল সেনারা যখন বুঝতেন পরাজয় কাছাকাছি, তখন তারা এই সুড়ঙ্গ দিয়ে দুর্গের দেয়াল পেরিয়ে যেতেন। সুড়ঙ্গপথের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আজ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ হয়নি। তাই এটি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে এক বিরাট রহস্য।

আজও এই সুড়ঙ্গের সামনে তারা জড়ো হয়ে দাঁড়ান। সাধারণের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় বা কৌতূহলবশত কেউ যাতে এর ভিতরে প্রবেশ না করে, সে জন্য সুড়ঙ্গমুখে ফটক নির্মাণ করে তাতে তালা দেওয়া হয়েছে বলে জানান আনসার সদস্য মোখলেছুর। এই সুড়ঙ্গ ছাড়াও দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ রয়েছে লালবাগ কেল্লার জাদুঘর নিয়ে। সুরম্য দ্বিতল দরবার হলটিই জাদুঘর।

সেখানে স্থান পেয়েছে মুঘল আমলে ব্যবহূত ১২ মডেলের রাইফেল। হাতে লেখা কোরআন শরিফ। যেন শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা প্রতিটি আরবি হরফ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি হাতে লেখা। সুবেদারদের ঝাড়বাতিগুলো দেখলে যে-কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে।

এক অপরূপ সৌন্দর্য, সবখানে শৌখিনতার ছোঁয়া। মনে হবে সেটিই আধুনিকতার সর্বশেষ সংস্করণ। খাবারে ব্যবহূত সিরামিকসের তৈজসপত্র নিয়ে আছে চমকপ্রদ তথ্য। খাদ্যে ভেজাল কিছু থাকলে ভেজাল উপকরণগুলো ওই থালা-বাটিতে কালো রং ধারণ করত। গোসলখানাটিতে ছিল ঠাণ্ডা ও গরমপানির সুব্যবস্থা। ছিল পৃথক কাপড় পরিবর্তনের ঘর ও টয়লেট।

গোসলে ব্যবহূত পুরো ঘরটি টাইলস লাগানো। এখানেও নকশার অনন্য গাঁথুনি। কথা হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা চার্লস নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভ্রমণ আমার একমাত্র শখ। ব্রিটিশ কলোনির বিভিন্ন ইতিহাসে এই দুর্গের কথা জেনেছি। এখন এটি সশরীরে এসে দেখতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।’

সরেজমিনে দেখা যায়, কেল্লার প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকে একটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে একটি সমাধি, পরী বিবির সমাধি। সমাধিসৌধের বিভিন্ন অংশ নির্মাণ করা হয় ফুলেল নকশাখচিত জালি ও ফলক দিয়ে। পরী বিবি ছাড়াও রহমত বানু নামও ছিল তার। পরী বিবির পাশে আরেকটি কবর রয়েছে। এটি শায়েস্তা খাঁর কথিত ছোট মেয়ে সামশাদ বানুর। পেছনের সামাধি হলো শায়েস্তা খাঁর বিশ্বস্ত সহ-সেনা অধিনায়ক খোদাবক্সের। অর্থাৎ মির্জা বাঙালির।

এখনো দেশি-বিদেশি অগণিত মানুষ দেখতে আসেন মুঘল স্মৃতিবিজড়িত এই লালবাগ কেল্লা। রবিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন এই কেল্লা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। বাংলাদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ২০ টাকা এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ১০০ টাকা মূল্যে টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। সন্ধ্যায় পুরো কেল্লায় জ্বলজ্বল করে দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা। জানা যায়, আগে ঢাকার সুবেদারদের থাকার জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে সুবেদার আযম শাহ ১৬৭৮ সালে ঢাকায় সুবেদারদের স্থায়ী প্রাসাদদুর্গ করার প্রথম উদ্যোগ নেন।

তিনি অত্যন্ত জটিল একটি নকশা অনুসরণ করে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি দুর্গের নামকরণ করেন কিল্লা আওরঙ্গবাদ। কিন্তু পরের বছর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ফেরত পাঠান। এ সময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। এরপর সুবেদার হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা আসেন শায়েস্তা খাঁ। শায়েস্তা খাঁর মেয়ে পরী বিবির সঙ্গে শাহজাদা আযম শাহর বিয়ে ঠিক ছিল। আযম শাহ হবু শ্বশুরকে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন।

শায়েস্তা খাঁ দুর্গের কাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু ১৬৮৪ সালে তার অতি আদরের মেয়ে পরী বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনাকে অশুভ মনে করে দুর্গের প্রায় ১২ শতাংশ সম্পন্ন করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন শায়েস্তা খাঁ। এর পরিবর্তে নির্মাণ করেন চিত্তাকর্ষক পরী বিবির মাজার বা পরী বিবির সমাধিসৌধ। দুর্গের নিয়ম অনুযায়ী একটি ভূগর্ভস্থ পথও নির্মাণ করা হয়।

আত্মরক্ষা কিংবা প্রয়োজনে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণত এ পথ ব্যবহূত হয়। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্বের সুড়ঙ্গটিই এ পথ। হাম্মামখানা, একটি পুকুর খনন, তিনটি সুদৃশ্য তোরণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে দুর্গ প্রাচীরের নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি করে পলকাটা তোপ মঞ্চ নির্মাণ করে এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়।

শেয়ার করুন: