অবশেষে মুখ খুললেন ঢাবির সেই মোর্শেদা

আমার রগ কাটেনি। রগ কাটার কোনও ঘটনাও ঘটেনি। তবে যারা আন্দোলনে গিয়েছেন, তাদের অনেককেই নির্যাতন করতেন ইফফাত জাহান এশা। আমরা তার প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই প্রতিবাদ করতে গিয়ে, জানালার কাঁচে লাথি মারতে গিয়ে আমার পা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ কেউ এটাকে রগ কাটা বলে ছড়িয়ে দেয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী মোর্শেদা খানম।

বর্তমানে ক্যান্টনমেন্টের মানিকদী এলাকায় মামার বাসায় অবস্থানরত ঢাবির উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী ১৯ এপ্রিল দেশের একটি অন্যতম গণমাধ্যমের এ সব কথা বলেন।

প্রতিবেদককে মোর্শেদা বলেন, আমরা একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলাম। এই প্রতিবাদ আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ছিল না। প্রতিবাদটা ছিল ইফফাত জাহান এশার বিরুদ্ধে। তিনি আগেও ছাত্রীদের নির্যাতন করেছেন।

তিনি বলেন, আমরা যারা পলিটিক্যাল মেয়ে কিন্তু কোটা আন্দোলনে যাই, তারা কথা বলছিলাম যে, হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। ওই দিন রাতেও তেমনটাই ঘটেছিল। রাত ১২টার দিকে একটা মেয়ে হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার করে ওঠে। উনার (এশা) রুমটা আমাদের ওপরে। আমরা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। হলের সবাই শুনেছেন।

সুফিয়া কামাল হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে থাকা মোর্শেদা খানম বলেন, চিৎকার শুনে আমরা সবাই রুম থেকে বের হয়ে ব্যাপারটা কী, তা জানার জন্য যাই। এশা আপুর রুমের সামনে দেখি হলের সব মেয়ে চলে এসেছে। গিয়ে দেখি, মেয়েরা আপুর রুমের দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে। আপু ভেতর থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা হচ্ছে।

তিনি উল্টো বলেছেন, ‘আমি কিছু করিনি। এখানে তেলাপোকা।’ তখন সবাই আবারও দরজায় এবং জানালাতে আঘাত করে। আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। চোখের সামনে দেখেছি, এর আগেও দুদিন আমাদের সামনেই অনেকগুলো মেয়েকে মেরেছেন। অডিও রেকর্ড বের হয়েছে, গালিগালাজ করছেন। মেয়েরা সবাই অনেক অতিষ্ঠ ছিল। তারা বাইরে থেকে দরজায় আঘাত করে, তার (এশার) বের হয়ে আসার জন্য। কিন্তু আপু কিছুতেই বের হচ্ছিলেন না। জানালাটা আগে থেকেই ভাঙা ছিল।

জানালায় আগেই অনেকে লাথি মেরেছি। কিন্তু এক্সিডেন্টালি আমি যখন আঘাত করেছি (জানালায়), তখন আমার পা-টা কীভাবে যেন কেটে গেছে। এক্সিডেন্টালি হয়েছে এটা। তারপর রক্ত দেখে কাউকে কিছু বলিনি। জানালায় লাথিতো আমি দিয়েছি, আমি কাকে কী বলবো? আমি নিচে নেমে আসি। তখন ওখানে অনেক মেয়ে ছিল। অনেকেই আমাকে বলেছে যে, ‘আপনি বলেন— কী হয়েছে?’ আমি কিন্তু কখনও বলিনি যে, আমার রগ কেটে দিয়েছে। ভিডিওতে দেখবেন, সেখানেও কিন্তু আমি বলিনি যে, আমার রগ কেটে দিয়েছে। ওখানে অনেকে ছিল। তখন কে কী বলেছে, আমি তো জানি না। আমার অবস্থাও তখন অতটা ভালো ছিল না।

মোর্শেদা বলেন, ‘ওই রাতে আমি একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছি যে, মেয়েরা অত্যাচারিত হচ্ছে সেজন্য। আমরা কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের বিরোধী না। নিজেরাই ছাত্রলীগ করি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অবশ্যই আমাদের ভেতরে আছে, না থাকলে ছাত্রলীগে যেতাম না। কিন্তু আমরা কথা বলেছি, ইফফাত জাহান এশার বিরুদ্ধে। তিনি অত্যাচার করছেন। আমরা কিন্তু ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কিছু বলি নাই। পরবর্তী স্টেপ তো আপনারা দেখছেনই। তখন হয়তো ওই অবস্থাতেই রগ কাটার বিষয়টা ছড়িয়ে পড়ছিল। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকরা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ব্লিডিং হচ্ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি হাসপাতালেও বলেছি, ম্যাডামকেও বলছি যে, আমার পায়ের রগ কাটেনি। ম্যাডাম একটা পোস্টও দিয়েছিলেন। তিনি (এশা) আমার স্টেটমেন্টের জন্যই বেঁচে গেলেন। এখন তিনি আমাদেরকে এখানে ইনভলব করছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনও অ্যাকশন নিতে পারে, এই আশঙ্কা করে মোর্শেদা বলেন, ‘আমাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমি এখন একটু অসুস্থ। ফলে এসব কিছু ভাবছি না। ছাত্রলীগ করেছি ঠিক আছে, কিন্তু এখনতো আমার স্টুডেন্টশিপ-ই হুমকির মুখে। যদিও এটা নিয়ে ক্লিয়ারকাট কোনও কিছু বলে নাই।

কিন্তু অনেক কিছু হচ্ছে। আমি একটু ভয় পাচ্ছি। আমার শঙ্কা হচ্ছে— আমরা যারা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তারা সবাই মিডল ক্লাসের ছেলেমেয়ে। আমরা চিন্তাই করতে পারিনি যে, একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে এমনটা হবে। আমরাতো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছি। আমরা কোনও অন্যায় করি নাই। আমাদের সঙ্গে এটা কেন হবে? এখনও কিছু বলতে পারছি না। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তারা যদি বিষয়টা বুঝতে পারেন, তাহলে (বহিষ্কার) করাটা লজিক্যালি হবে না।’

মোর্শেদা বলেন — ‘পুরো বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্ত না করেতো একজন স্টুডেন্টকে বহিষ্কার করা উচিত না। একজনকে বহিষ্কার করা মানে, একজনের লাইফ নিয়ে কথা বলা। আমরা ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট। শিক্ষা জীবন শেষের দিকে। আমরা চাই, সুষ্ঠু তদন্ত হোক।’

ইফফাত জাহান এশার সঙ্গে আগে থেকেই কোনও দ্বন্দ্ব ছিল কিনা জানতে চাইলে মোর্শেদা বলেন, ‘আগের কমিটিতেও আমি সহ-সম্পাদক ছিলাম। শুধু আমি না, আমাদের যাদের-যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তারা অনেকেই আগের কমিটিতে ছিলাম। তারপর নতুন কমিটি যখন দিয়েছে, তখন এশা আপুই আমাদের সহ-সভাপতি হিসেবে যুক্ত করিয়েছেন।

প্রথম দিকে আপু ভালো ছিলেন। পরবর্তীতে কিছু একটা হয়েছে। এত বিস্তারিত আমি বলতে চাচ্ছি না। আমাকে নিয়ে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে। আর অনেক মেয়েই তো স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। অনেক মেয়েই কথা বলেছেন। শুধু আমার কথার ভিত্তিতে যে হয়েছে, তা কিন্তু না। সে রাতে আমার মনে হয়েছিল যে, প্রতিবাদ করা দরকার। আমি করেছি।’

মোর্শেদা খানম বলেন, ‘তার (এশা) সঙ্গে কখনও আমার রিলেশন খারাপ ছিল না। তিনি আমাকে কখনও খারাপ চোখে দেখতেনও না। কিন্তু কথাটা তো খারাপ চোখে দেখার বিষয় না। আমার সামনে তিনি অন্য মেয়েদের সঙ্গে অন্যায় করেছেন, আমার সঙ্গে না করুক। আমি এর প্রতিবাদ করেছিলাম। তিনি (এশা) যে নির্যাতন করতেন, সেটা আগেও নিউজ হয়েছে। তিনি আগেও মেয়েদের হল থেকে বের করে দিতেন।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে মোর্শেদার ভাষ্য— ‘কোটা আন্দোলন নিয়েই-তো সব হলো। আপনারা তো দেখেছেন, এটা কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন না। এখানে সাধারণ ছাত্র, পলিটিক্যাল ছাত্র সবাই গিয়েছিল। এটাতো একটা নৈতিক আন্দোলন। অনেক মেয়ে আন্দোলনে যেত। মেয়েরা মূলত ৮ এপ্রিল থেকে আন্দোলনে ইনভলব হয়েছে। ৮ তারিখ রাতে তো ভার্সিটিতে ভয়াবহ একটা রাত গেছে। আমরা পলিটিক্যাল অসংখ্য মেয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম।’

এদিকে হলে ছাত্রীদের নিয়মিত নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে ইফফাত জাহান এশা অসুস্থতার কথা জানিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন। পরবর্তীতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

মোর্শেদাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘ওই রাতের ঘটনায় যখন রগ কাটার গুজব ছড়িয়েছিল, তখন মোর্শেদা বিষয়টি ক্লিয়ার করেনি। সে যদি বিষয়টা পরিষ্কার করতো, তাহলে গুজবটি ছড়াতো না। দায়িত্বে অবহেলার কারণে ছাত্রলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, কোটা বিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার কারণে হল সভাপতি এশা একছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে, রাতেই এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ কারণে মধ্যরাতে আবারও রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। তারা এশাকে জুতার মালা গলায় দিয়ে লাঞ্ছিতও করেন। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করা হয় এশাকে। আর পরিদন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কার করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু ঘটনার দুদিনের মাথায় নিজেদের তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নিজেদের তদন্তের ভিত্তিতে এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। পরবর্তীতে যে ছাত্রীর পায়ের রগ কাটার গুজব উঠেছিল, সেই মোর্শেদাসহ ২৪ জনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

শেয়ার করুন: