সড়ক দুর্ঘটনায়

যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনার পর গাড়িচালক পালিয়ে যান

সড়ক দুর্ঘটনার পরপরই দেখা যায়, বেশির ভাগ গাড়িচালক পালিয়ে যান। কখনো গাড়ি নিয়ে, আবার কখনো গাড়ি ও যাত্রীদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সড়কে ফেলে রেখেই পালিয়ে যান। মাঝে মধ্যে যাত্রী ও পথচারীদের সহযোগিতায় গাড়িচালককে আটক হয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই তাদের ধরা যায় না। অনেক সময় গাড়িচালক দুর্ঘটনার পরেও গাড়ির চাকার সঙ্গে বাঁধিয়েও আহত ব্যক্তিকে বহুদূর টেনে-হিচঁড়ে নিয়ে যান।

এই বিষয়টি নিয়ে জনমনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন রয়েছে- গাড়িচালকদের এমন আচরণের কারণ কী? জনরোষ এড়ানো? নাকি অন্য কোনো কিছু? এ রকম বহু প্রশ্ন আছে।

তবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে এমন বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানের মতে, অধিকাংশ গাড়িচালক ও গাড়ির কাগজপত্র ত্রুটিপূর্ণ। এ কারণে দুর্ঘটনার পর তারা আর ঘটনাস্থলে থাকেন না। জনরোষে পড়ার আশঙ্কাটাও অন্যতম একটা বড় বিষয়। তাই দুর্ঘটনার পরপর তারা পালিয়ে যান।’

এ ব্যাপারে সব মিলিয়ে অন্তত ৫০ জন গাড়িচালকের (বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যান) সঙ্গে কথা বলা হয়। কেন- দুর্ঘটনার পর চালকরা পালিয়ে যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো কোনো চালক গুরুত্ব সহকারে উত্তর দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ হেসে হেসে বলছেন, ‘পাবলিকের গণধোলাই খাওয়ার চেয়ে পালিয়ে যাওয়া ভালো।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাস চালক গণমাধ্যকে জানান, ‘আসলে দুর্ঘটনা তো কেউ ইচ্ছা বসত করে না, এটা হঠাৎ করে হয়ে যায়। যেকোনো সড়ক দুর্ঘটনার পরপর যাত্রী ও পথচারী সবাই মিলে এক হয়ে যায়। এরপর গাড়িচালককে প্রচুর মারধর করে। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটনার পরপরই চালক পালিয়ে যায়। কোনো চালকই বসে থেকে মারধর খেতে চায় না।’

যখন কেউ গাড়ির নিচে পড়েছে, এটা দেখেও চালক গাড়িটি তার শরীরিরের ওপর দিয়ে চালিয়ে চলে যায়, কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এক চালক প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘দুর্ঘটনার সময় ওই চালকের মাথা ঠিক মতো কাজ করে না।’

সড়কে অনেক ট্রাক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে, আপনি কি কখনো পড়েছেন এবং দুর্ঘটনার শিকার কোনো ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন? এ প্রশ্নে এক ট্রাকচালক প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ট্রাকের সঙ্গে অনেক ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর সেই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমন কোনো ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে পারিনি। সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছি। আবার কখনো গাড়ি বন্ধ করে রেখে চলে এসেছি। কেননা, পাবলিক চালককে পেলে প্রচণ্ড পরিমাণে মারধর করে। এ কারণে পালিয়ে আসছি।’

নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন অবশ্য দুর্ঘটনার পর গাড়িচালকের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যকে বলেছেন, ‘গাড়ি চালক ও সাধারণ মানুষ উভয়ই জানে সড়কে এই মৃত্যুর কোনো বিচার হয় না। তাই গাড়ি চালক দুর্ঘটনার পর যদি পালিয়ে যেতে পারে, তাহলে তার আর শাস্তি পেতে হবে না। এছাড়া তিনি বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতায় ছাড়া পাবেন। আইনে যে সাজা আছে তাও কম। এদিকে, সাধারণ মানুষও জানে চালকদের কোনো বিচার হয় না, তাই তারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়। চালককে পেলে মেরেই ফেলবে এমন অবস্থা।’

ইলিয়াস কাঞ্চন আরো বলেন, ‘আমাদের আইন পরিবর্তন করা দরকার। তাহলে এভাবে পালিয়ে গিয়েও কেউ রক্ষা পাবে না। পৃথিবীর কোথাও এমন দৃষ্টান্ত নেই, চালক গাড়ি রেখে যেভাবে লাফিয়ে পরে পালিয়ে যায় তাদের সংগঠনগুলোও এই পালানোকে সমর্থন করে। তাই তারা চলন্ত গাড়ি থেকেও লাফিয়ে পরে পালিয়ে যায়।’

নিসচা’র তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ বেপরোয়া গাড়ি চালনা, ট্রাফিক আইন না মানা বা অমান্য করার সংস্কৃতি। এছাড়াও অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় এই প্রবণতা কোনোভাবেই কমছে না। তাদের দাবি, দেশের সব হাইওয়েগুলোয় গতি নির্ণয়ক যন্ত্রস্থাপন করা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যসূত্রের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ এই তিন মাসে ১ হাজার ৪২৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সারাদেশে এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৫৬ জন। এটি গড়ে প্রায় প্রতিদিন ১৬ জন মানুষ সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৩৮০ জন। এই সড়ক দুর্ঘটনার ফলে এদের মধ্যে বহু মানুষ পঙ্গু হয়ে অসহায় জীবন-যাপন করছেন।

শেয়ার করুন: